পৃথিবীতে যত ভাষা আছে সেগুলোর সঙ্গে বাংলা ভাষার তফাৎ এ যে বাংলা ভাষার নিজস্ব সংগ্রামের এক দীর্ঘ ইতিহাস আছে। যা অন্য ভাষার নেই। এমনকি এ দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়েছিল। হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বাঙালি জাতি দীর্ঘ পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তিলাভ করে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দাবি আদায়ের মাধ্যমে।
বাঙালির মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে বাঙালির রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলে তা তীব্রভাবে প্রতিরোধ করা হয় এবং এই দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়। বাংলা ভাষা নির্মূল করা যেমন তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, তেমনি এর পেছনে আরও গভীর এবং সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রজাল বিস্তার করে রেখেছিল পাকিস্তানি শোষকরা। যার পরিণতি আমরা দেখতে পাই রাষ্ট্রযন্ত্রের সবস্তরে বাঙালিকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সব উন্নয়নমূলক কাজ হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করতে তারা বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার অশুভ পাঁয়তারা শুরু করে। আর সে জন্যই তারা প্রথমে আঘাত হানে ভাষার ওপরে। বাঙালিকে দমিয়ে রাখতে তারা এ পদ্ধতিই অনুসরণ করে। কিন্তু অকুতোভয় বীর বাঙালির কাছে শেষ পর্যন্ত তাদের নতিস্বীকার করতেই হয়।
শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের শাসকরা ধর্মের দোহাই দিয়ে বাঙালির মাতৃভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। পূর্ব বাংলায় বাঙালির অর্জিত সব সম্পত্তি পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভোগ করলেও যখন মাতৃভাষা কেড়ে নিতে চাইল, তখন দেখা যায় যে বাঙালির আমিত্ব থাকে না। বাঙালির নিজস্ব যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তা আর থাকত না। মাতৃভাষা কেড়ে নিয়ে জোর করে উর্দু প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার যে ঘৃণ্য চক্রান্ত তারা করেছিল- তার মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিকে শুধু শোষণই করে যেত। বাঙালি কখনও আর পৃথিবীর ইতিহাসে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত না।
বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলা। বাংলা ভাষার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির ইতিহাস। আর্য আগমনের কাল হতেই এদেশের মূল অধিবাসী অর্থাৎ অনার্যদের দেখা হয় ঘৃণার চোখে। প্রায় চার হাজার বছর আগে আর্যরা প্রথমে প্রবেশ করে উত্তর ভারতে এবং বাংলায় প্রবেশ করতে তাদের আরও এক হাজার বছর সময় লাগে। বাংলার মানুষকে তারা বর্বর আর ঘৃণিত বললেও বীর বাঙালির অসম সাহসিকতার কাছে সহজে তারা জয়লাভ করতে পারেনি। আর্য আগমনের পর হতেই এদেশের রাজকীয় বা রাষ্ট্রীয় ভাষা কখনওই বাংলা হতে পারেনি। অপরদিকে সাধারণ বাঙালির মুখের ভাষা ছিল বাংলা। যার নিদর্শন আমরা পাই চর্যাপদের পদগুলোয়। চর্যাপদ আবিষ্কারের পর আমরা বাংলা ভাষার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে যেমন জানতে পারি তেমনি হাজার বছর আগের বাঙালির জীবনধারা সম্পর্কেও জানতে পারি। যদিও বাংলা ভাষার বিকাশের ইতিহাস আরও প্রাচীন। চর্যাপদ ধর্ম না সাহিত্য সে বিষয়ে বিতর্ক থাকলেও সেটি যে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধারণ করে আছে সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক থাকার কথা নয়।
বর্তমান বাংলা ভাষা নানা বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থায় এসেছে এবং উত্তরোত্তর উত্তরাধুনিক নানা বিষয়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে নিতে নতুন থেকে নতুনতর-রূপলাভ করতে যাচ্ছে। এ কথাটি বলার কারণ হলো বর্তমানে বাংলা ভাষার ভন্নদশা দেখে। পূর্ববঙ্গের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে আরবি হরফে বাংলা ভাষা লেখার অপচেষ্টা করা হলে তার বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন হয়। অথচ বর্তমানে আমরা দেখি ভিন্নচিত্র। অবাধে বাংলা ভাষার মর্যাদাহানি হলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই আমাদের। যেন বোধশক্তি রহিত হয়ে গেছি আমরা।
যত্রতত্র বানান ভুলের যেন মহোৎসব চলেছে। আর বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুনে তো যে যত বেশি বিদেশি শব্দ ব্যবহার করবে, তার মর্যাদা তত বাড়বে বলে মনে হয়। শুধু ফেব্রুয়ারি মাস এলে সবার টনক নড়ে ভাষার মাস বলে কথা।
আমাদের দেশের তথাকথিত শিক্ষিত জনসমাজ নিজেদের স্বজাতীর ভাষা-সংস্কৃতি ভুলে অন্যের অন্ধ অনুকরণ করার কারণেই আমরা নিজেদের ভাষা নিয়ে চিন্তিত হচ্ছি। আর এর পুরোভাগেই আছেন উচ্চশিক্ষার নামধারী কিছু মানুষ। যারা মনে করেন ইংরেজি জানলে তারা উচ্চশিক্ষিত হয়ে গেছেন। অথচ তারা নিজের মাতৃভাষাটাই ভালো করে জানেন না। এসব শিক্ষিত সমাজ তাদের সন্তানদের জন্মের পর হতেই বাংলা না শিখিয়ে ইংরেজি শেখান। ছোট্ট ছোট্ট সোনামণিরা ভাঙা ভাঙা বাংলা না বলে ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলে। সেই বাচ্চারই মায়ের মাতৃভাষা বাংলা এবং অনেকের জন্ম গ্রামে হলেও উচ্চশিক্ষার মোহে নিজের সন্তানদের চেয়ে নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির যে বিশাল ক্ষতি তারা করছেন তা বোঝার ক্ষমতাও তারা হারিয়ে ফেলেন। কবি আব্দুল হাকিমের মতো আজও বলতে হয় ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি॥/ দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।/ নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়॥’
মাতৃভাষার স্বরূপ কী তা না জানলে, মাতৃভাষা চর্চা করা সম্ভব নয়। মাতৃভাষা চর্চা কেন কোনো ভাষাই চর্চা করা সম্ভব নয়। আরবি, উর্দু, ফার্সি, ইংরেজি, জার্মান, জাপানী, ফরাসি, চীনা, হিন্দি, তামিল, তেলুগু যে ভাষাই আমরা চর্চা করি না কেন সর্বাগ্রে নিজের মাতৃভাষা কী তা জানতে হবে। মাতৃভাষা মানে মায়ের ভাষা। এখন আমরা প্রমিত বাংলায় কথা বলি। প্রমিত বাংলা মানে সর্বজনগ্রাহ্য বাংলা ভাষা। আগে এটি ছিল না। বাংলা ভাষাভাষী বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা বিভিন্ন রকম হওয়ায় সবার বোঝার সুবিধার জন্য প্রমিত বাংলার ব্যবহার শুরু হয়। মূল ভাষা হলো আঞ্চলিক ভাষা যাকে আমরা বলি মায়ের ভাষা। অথচ অনেক শিক্ষিত মূর্খ তা বোঝার চেষ্টাও করেন না। তারা প্রমিত বাংলাকেই নিজের মাতৃভাষা বলে দাবি করেন। প্রমিত বাংলাও কোন অঞ্চলের মাতৃভাষা। তবে তা সব অঞ্চলের মানুষের মাতৃভাষা হতে পারে না।
বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে হলে প্রথমে উপভাষা তথা আঞ্চলিক ভাষাকে রক্ষা করতে হবে। আর তা না হলে বাংলা ভাষা তার স্বাতন্ত্র্য হারাবে। তীব্র প্রতিযোগিতার এই সময়ে আমরা এরই মধ্যে বাংলা ভাষার অনেক আঞ্চলিক শব্দ হারিয়ে ফেলেছি। যা আমরা খেয়াল করারও সময় পাইনি। এভাবে এমন এক সময় আসবে, যখন পেছন ফিরে দেখারও সময় থাকবে না। থাকবে শুধু দীর্ঘশ্বাস আমরা কী হারালাম। বিগত কয়েক দশকে আমরা আমাদের আঞ্চলিক শব্দগুলো রক্ষার সমন্বিত কোনও উদ্যোগ করিনি।
লোকমুখে প্রচলিত ছিল বলেই বাংলা ভাষা আজও টিকে আছে। কালের গর্ভে হারিয়ে যায়নি। যেমনভাবে হারিয়ে গিয়েছে অনেক প্রভাবশালী ভাষা সংস্কৃত তাদের মধ্যে অন্যতম। শুধু সমাজের উচ্চশ্রেণির লোকের ভাষা হওয়ায় তা টিকে থাকেনি। উচ্চশ্রেণির মানুষের ভাষা সংস্কৃত ব্যাকরণ দ্বারা সংস্কার হয়েছিল বলে তার নাম সংস্কৃত ভাষা। বাংলা ভাষা রক্ষায় যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে তাতেও মনে হয় বাংলাকে তারা উচ্চশ্রেণির মানুষের ভাষা মনে করে তার যথাযথ সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। তারা এটা মনে করছেন না যে, ব্যাকরণ সৃষ্টি হয়েছে ভাষাকে বিশ্লেষণ করার জন্য, ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নয়। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ৭২ বছরে এসে আমরা বাংলা ভাষার মর্যাদা কতটা রক্ষা করতে পারলাম তার হিসেব মেলানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা এখনও আমরা দাবি জানিয়ে আসছি, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের। যা আমাদের ভাষা সম্পর্কে দন্য-দশারই পরিচয়বহন করে। শুধু যে আমাদের দন্য দশারই চিত্র দেখা যায় তা নয়। অনেক সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বাংলাভাষা চর্চার বিষয়টিও চোখে পড়ার মতো। যা আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করে। অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে শুদ্ধভাবে বংলাভাষা চর্চার জন্য। কিন্তু সচেতনভাবে অবহেলার কারণে বিশেষ করে শিক্ষিত সমাজের অবহেলার কারণে আমরা আশাহত হই। ভাষা-আন্দোলনে যেমন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সচেতন হয়েছিল, তেমনিভাবে সবাই সচেতন না হলে ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে না।
বাংলা ও অন্যান্য ভাষাচর্চার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে গড়ে উঠলেও আঞ্চলিক ভাষাচর্চার জন্য কোনও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে বলে আমার জানা নেই। বাঙালি যেন নিজ ভাষা-আত্মপরিচয় রহিত না হয়ে পড়ে, সেজন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা আশু প্রয়োজন হোক তা সরকারি বা ব্যক্তিপর্যায় থেকে। একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ভাষা এবং উচ্চারণে পার্থক্য থাকবে এটা স্বাভাবিক। সব অঞ্চলের মানুষের ভাষার স্বাতন্ত্র্য আছে এবং থাকবে। সেগুলো যথাযথ সংরক্ষণ এবং সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রমিত বাংলাভাষার প্রয়োজন অনস্বীকার্য তবে আঞ্চলিক ভাষাকে বাদ দিয়ে নয়।
আ. স. ম. শিবলী শিহাব
উপ-প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক, বাংলা বিভাগ অ্যালামনাই, রাজশাহী বিশ্বাবিদ্যালয়